একটি জীবন দোয়েলের দেশে || মো. আরিফুল হাসান
একটি জীবন দোয়েলের দেশে || মো. আরিফুল হাসান

একটি দিবসকে মনে হলো তার কাছে কালপার্বনের মতো। একটি দিবসে সে জলের জোয়ারে ভেসে গেলো। তার কাছে দিনরাত্রিগুলো লেপ্টে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে, দিনের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে অজ¯্র দিন। সে রাতের অপেক্ষা করে। রাত আসলে আবার ভোর হয় না। রাতের পেট থেকে অসংখ্য রাত বের হতে থাকে। রাতের চোখে চেয়ে থাকে সে। চেয়ে থাকে দিবসের রোদে। তার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়, ঘোলা হয়ে আসে। তবুও রাত ফুরায় না, দিন ফুরায় না। রাতদিন চলতে থাকে মহাকাল হয়ে। যেনো এর কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। সমস্ত ক্যালেন্ডারের সংখ্যাগুলো যেনো মুছে যায়। ঘড়ির কাটাগুলো যেনো পাথর হয়ে জমে আছে এক জায়গায়, স্থির। করিম কোন দিকে যাবে ভেবে পায় না। সে টের পায়, তার ভুলের জন্যই আজ তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কি করবে? ঘরের বৌ, সেও এই অপমান সইতে পারেনি। রাগের মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করেছে রইজুদ্দীর মাথায়। আর তাতেই মাথা ফেটে অক্কা গেলো বুড়োটা। করিম চায়নি রইজুদ্দিকে হত্যা করতে। সে শুধু জেদের বসে আঘাত করেছিলো। কিন্তু মরে যাবে কে জানতো? তার বৌয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছে রইজুদ্দী। দুটো তো পাটশাক তুলতে গিয়েছিলো। তার জন্য অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল আর শেষ মেষ চুলের মুঠি ধরে ক্ষেতের আলে ফেলে দেওয়া। মেনে নিতে পারেনি করিম। ক্ষেত থেকে ফিরে গোসল করতে যাবে এমন সময় ঘটনাটি ঘটে। করিমই বলেছিলো, পেটটা তার খারাপ যাচ্ছে। যদি সম্ভব হয় বৌ যেনো দুটো পাট শাক ভেজে দেয়। কিন্তু পাটশাক আর খাওয়া হয় না করিমের। তার স্ত্রী যখনই পাটশাক তোলার জন্য বাড়ির পাশে রইজুদ্দীর ক্ষেতে যায়। অমনি কোথা থেকে যেনো রই রই করে ছোটে আসে রইজুদ্দী। প্রথমে গালাগাল করে। পরে কোচড় থেকে কেড়ে রেখে দেয় শাকপাতা। সবশেষে চুলের মুঠি ধরে তাকে ফেলে দেয় জমির আলে। সহ্য করে থাকতে পারেনি করিম। ছুটে গিয়ে কোনোকিছু না ভেবেই ক্ষেতের আলে পড়ে থাকা হিলবরাক বাঁশের গুড়ি দিয়ে আঘাত করে রইজুদ্দীর মাথায়। জবাই করা মুরগীর মতো দু’চারবার ছটফট করে তার চোখের সামনেই মরে যায় বুড়োটা।

বুড়োটার স্বভাব সম্পর্কে গ্রামবাসীরা জানতো। কিন্তু তা বলে খুন! করিমকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। তাদের বংশের এক ব্যারিস্টার তাকে ছাড়িয়ে আনে জামিনে। এখন ছাড়া পাবার পর করিম দেখতে পায়, ব্যারিস্টার তাকে এমনি এমনি ছাড়িয়ে আনেনি। আছে এর পেছনে আরেক উদ্দেশ্য। করিম গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী মরদ। গ্রামে যখন দল বাঁধে, করিমের অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন লোকের দেখা মেলে না। ব্যারিস্টার দাওয়ায় বসে চেয়ার পেতে। আরেকটি চেয়ার পেতে দেয় করিমকে। ব্যারিস্টার এবার স্পষ্ট করে বলে,
--কী করিম মিয়া, রাজি?
করিম কোনো কথা বলে না। মাটির দিকে চেয়ে থাকে স্থিরদৃষ্ট হয়ে। ব্যারিস্টার আবারও তাড়া দেয়।
--কী, কথা বলো না কেনো করিম মিয়া?
--জমি দিয়া দিলে খামু কী?
মাটির ভেতর থেকে জবাব দেয় করিম। তার কণ্ঠটি যেনো অতলান্ত থেকে ককিয়ে ককিয়ে উঠছে।
--আর যদি ফাঁসি হয়, তো?
--না, না, আমি মরতে চাইনা ব্যারিস্টার সাব। আমারে বাঁচান।
--তাহলে জমি লেখে দাও। মামলা থেকে অব্যাহতি এনে দেবো।
--তাইলে তো পরিবারের সবাই না খাইয়া মরবো, ব্যারিস্টার সাব। আমার একটা মাত্র জমি। মুর্খ মানুষ, নিজে চাষবাস কইরা খাই। ওইটাই আমার একমাত্র ভরসা।
--তাহলে আরেকটা পথ আছে।
--কী পথ ব্যারিস্টার সাব?
করিমের চোখ মুখ চকমক উছে। একমুহুর্তে সে একটি আশার আলো দেখতে পায়। কিন্তু পরক্ষণেই যেনো ঘন অন্ধকার নেমে আসে তার চোখে মুখে। ব্যারিস্টার কঠিন মুখে বলে,
--আরেকটা খুন করতে হবে তোমাকে,

২.
জহরুদ্দীন ব্যারিস্টার সুমনের আপন বড় ভাই। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় উনমনা থাকায় ভাগ্যে বাবার বিশাল জমিজিরাত দেখাশোনার ভার পড়ে তার উপর। ছোট ভাই সুমন পড়ালেখা করে ব্যারিস্টার হয়েছে। শহরে থাকে। জহরুদ্দীনই গ্রাম থেকে টাকা পয়শা জুগিয়েছে ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে। ভাই ব্যারিস্টার হয়েছে, এ নিয়ে কতো গর্ব জহরুদ্দীনের। যেদিন সুমন ব্যারিস্টারি পাশ করলো, জহরুদ্দীন তিন গ্রামের আলেম এনে শুকরানা মিলাদ পড়ালো। গ্রামের সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করলো। তার পর বিয়ে করে ভাই সুমন চলে গেলো শহরে। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে। মাঝে মধ্যে বছরে দুএকবার আসে পৈতৃক জমির ফসল বেচার টাকার ভাগ নিতে। জহরুদ্দীনরা দুই ভাই, আর কোনো বোন নেই। তাই তাদের সমস্ত সম্পত্তির ভাগ ভাটোয়ারা দু’ভাইয়ের মধ্যেই হয়। জহরুদ্দীন হাসিমুখে সবকিছু ভাগ করে দেয়। ছোটভাইয়ের ভাগটাই যেনো সে বড় করতে চায়। তার নিজের ছেলেপুলে হয়নি। বউটা অপরূপ সুন্দরী। জহরুদ্দীন ভাবে, তার আর এতকিছু দিয়ে কী হবে। কে খাবে তার রেখে যাওয়া সম্পদ। তাই সে গ্রামে থেকে এতটাই খরচ করে যা তার করার কথা তার চেয়েও কম। বাকিটা সে ভাইকে দেয়। সে জানে, সুমন ব্যারিস্টারি করে অনেক টাকা উপার্জন করে। তবুও তার ভালো লাগে ভাইকে দিতে। দেবার বেলায় একেবারে নিজেকে উজার করে দেয় জহরুদ্দীন। করিমকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার পেছনেও মূল ভুমিকা জহরুদ্দীনেরই। তার দয়ার শরীর, করিমের বৌ গিয়ে এলোকেশে পায়ে পড়েছে জহরুদ্দীনের। জহরুদ্দীনই ভাইকে দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে করিমকে। কিন্তু করিম এ কী শুনলো, ব্যারিস্টারের কথায় সে তার কানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করাতে পারছে না।
--জহরুদ্দীনরে মারতে হবে। বলো, রাজি?
হাউমাউ করে কেঁদেছে করিম, শেষে নিজের একমাত্র সম্বল জমিটাই লিখে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু বেঁকে বসেছে ব্যারিস্টার। তার এখন দ্বিতীয় দাবিটাই পূরণ হওয়া চাই। না হলে করিমকে আবার সে জেলে ঢোকানোর ব্যাবস্থা করে দেবে।

ব্যারিস্টারের ঘর থেকে বের হয়ে অনেকটা ঘোরগ্রস্থের মতো হাঁটছে করিম। সে এখন কি করবে? জহরুদ্দীনকে গিয়ে বলবে সে কথা? জহরুদ্দীন কি তার কথা বিশ্বাস করবে? আর যদি বিশ্বাস করেই তবে জহরুদ্দীন কি বাঁচাতে পারবে তাকে ফাসিকাষ্ঠ থেকে? করিমের মাথার ভেতর যেনো একটি বিধ্বস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠে। তা পা টলে পড়ে যেতে চায়। ব্যারিস্টার তাকে বলেছে, আজ রাতের মধ্যেই এ কাজ করতে হবে। না হলে কাল সকালে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। করিম বুঝতে পারছে না সে এখন কোন দিকে যাবে। ব্যারিস্টার সুমনদের বিশাল বাড়ি। উঠোনটা যেনো একটি বিরাট প্রান্তর। তার পরে একটি ফলের বাগান। বাগানের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে জহরুদ্দীনের ঘর। এটি তার বাবার আমলের করে যাওয়া। ছোটো ভাই ব্যারিস্টার সুমনের জন্য সেও একটি ঘর করেছে বাড়িটির অপর প্রান্তে। আধুনিক সজ্জায় মন মাতানো বাড়ি। সুমন বাড়িতে আসলে সে ঘরেই থাকে। জহরুদ্দীনের বৌ তাকে খাবার দিয়ে আসে। সুমন এ ঘরটায় খুব কমই আসে। করিমের একবার ইচ্ছে হয়, এ ঘরটাতে যায়। করিমের একবার ইচ্ছে হয় সে জহরুদ্দীনকে সব বলে দেয়। কিন্তু সে জানে, ব্যারিস্টারের শ্যেণ চোখ ঠিকই তার উপর লেপ্টে আছে। করিম ওদিকটায় যেতে ভয় পায়। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নামে। হাঁটতে হাঁটতে সে ধুলির সংখ্যা পরিমাপ করতে থাকে। সে দেখতে পায়, তার নাকে মুখে চোখে লেগে আছে অজ¯্র ধূলো, তার নাক মুখ চোখ বন্ধ হয়ে আসে, তার শ্রবন ইন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।

বাসায় এসে করিম কাউকে কিছু বলে না। বৌ ভাত বেড়ে দেয়। করিম চুপচাপ খায়। তার কণ্ঠে ভাতগুলো আটকে যেতে থাকে। বারবার সে পানি পান করে। বৌ এসে পাখা দিয়ে বাতাস করে মাথায়। করিমের মাথা থেকে আগুন নেভে না। একটি প্রত্যক্ষ হাবিয়াপৃথিবীর স্বরূপচিত্র সে দেখেছে, একটি লোভী পৃথিবীর সর্বনাশা জোঁক সে দেখেছে। সে জোঁক কামড়ে ধরেছে তার পাঁজরে। তীব্র দহনে সে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার বৌয়ের উপর। হাতের থালাটা ছুড়ে মারে।
--বেশ্যা মাগী, তোর জন্য সব এমুন হইছে।
করিমের বৌ ফ্যাল ফ্যাল নজরে তাকায়। সে বুঝতে পারে না, আবার নতুন করে কি ঘটলো তার স্বামীর সাথে। রইজুদ্দীর মৃত্যুর জন্য তাকে জেলে নিয়েছিলো। ব্যারিস্টার তো তাকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছে। আবার নতুন করে কি বিপত্তি ঘটলো তাহলে? করিম বলতে পারে না পারে না আবার কী ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে। তার ইচ্ছে করে বৌয়ের ফ্যালফ্যালে দুটো চোখ উপড়ে ফেলে দিতে। কিন্তু তার বৌওটিও এমন নিরীহ আচরণ করছে যে তার সাথে আর রাগ করা চলে না। করিম হাত ধুয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

৩.
দিনের বাকি সময়টা সে একটি জঙ্গলে বসে কাটিয়ে দেয়। গহীন জঙ্গলের একটি গাব গাছের নিচে বসে সে সাড়ে সাত প্যাকেট বিড়ি টানে। জনমানবহীন জঙ্গলে সে বার কয়েক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। জীবনের যুদ্ধ তাকে জয়ী করে দেয়। প্রতিবারই তার চেহারার সামনে ভেসে উঠে প্রিয়তমা বধুটির মুখ। মায়ের মতো গাঁয়ের ছবিটি তাকে মরতে দেয় না। অন্ধকার নেমে আসে। করিম ধীরে ধীরে জঙ্গল থেকে বের হয়। কোথায় যাবে সে এখন জানে না। একসময় আনমনে সে বাড়িতে চলে আসে। ঘরে এসে দরোজায় খিল এঁটে বসে থাকে। তার স্ত্রী খাবার ওজুর পানি দেয়, করিম হাত মুখ ধোয় না। তার চেহারায় ধূলো আর মলিনতা ভয়ানকভাবে ফুটে উঠে। করিম টের পায়, ধূলায় তার চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। ক্ষাণিক্ষণ সে মরার মতো পড়ে থাকে। তারপর একসময় কখন যে চোখ লেগে আসে সে বলতে পারে না। রাতে একটি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে করিমের ঘুম ভাঙ্গে। চারিদিকে নিশ্চুপ রাত। সে বাইরে বের হয়। চাঁদ ডুবে গেছে। একটা স্যাঁতস্যাঁতে আঁধার লেপটে আছে সবখানে। করিম পায়ের থিতে পথ চলে। যথাসম্ভব নিঃশব্দে যে এগিয়ে যায় জহরুদ্দীনের বাড়ির দিকে। রাতের পথে শন শন করে কোনো নিশাচর ছুটে চলে। হিস হিস করে চলে যায় কোনো সরিসৃপ। করিম আওয়াজ সংবরণ করে গলা খাকাড়ি দেয়। একটু থামে। আবার সে পথ চলে সন্তর্পনে, চোরের মতো। করিম সাথে কোনো অস্ত্র নেয়নি। সে জহরুদ্দীনকে খুন করতে যাচ্ছে না। সে যাচ্ছে জহরুদ্দীনের বৌকে ব্যাপারটি জানাতে। তিনি হয়তো বুঝিয়ে বললে ব্যাপারটি বিশ্বাস করবেন। করিম বিকেল বেলায় জঙ্গলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। সে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। কিন্তু ব্যারিস্টারের কুবুদ্ধিতে জহরুদ্দীনকে সে খুন করতে পারবে না কিছুতেই। তাই সে জহরুদ্দীনের বৌকে এ ব্যাপারে সাবধান করতে যাচ্ছে। যাতে ব্যারিস্টার সুমন অন্য কোনো উপায়ে ছোবল মারতে না পারে জহরুদ্দীনের উপর।

জহরুদ্দীনের পুরানা দিনের টিনের আটচালা ঘর। শোবার দিনের টিনে কয়েকটা স্ক্রুর ফুঁটো আছে। চালের টিন সংস্কার করে বেড়ায় লাগানোতে এ ছিদ্রগুলো থেকে গেছে। করিম টিনের ফুটো দিয়ে ঘরের ভেতর চোখ রাখে। একটি অনুজ্জ্বল হারিকেন ঘরটিতে আবছা আলো ফেলছে। আর তাতে করিম দেখতে পায় খাটে জহরুদ্দীন একলা শুয়ে আছে। করিম ভাবে, জহুরুদ্দীনের বৌ বুঝি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে। কিন্তু দরজার দিকে চোখ পড়লে সে আঁৎকে উঠে। জহরুদ্দীনের ঘরের দরোজা হাট খোলা। করিম ঘরের পেছন দিয়ে এসেছে, তাই সে দরজা দেখতে পায়নি। করিমের মনে সন্দেহ হয়। সে একবার ঘুরে বাড়ির সামনে দিকে আসে। জহরুদ্দীনের বৌয়ের কোনো উপস্থিতি সে টের পায় না। ঘরের সামনে বিশাল ফল বাগান। নানা রকম ফল গাছ সেখানে। করিম দেখতে পায় বাড়ির শেষ প্রান্তে ব্যারিস্টারের ঘর থেকে একটি আলো দেখা যাচ্ছে। রহস্যটা বুঝে উঠে না করিম। কৌতুহল বশে সে পা বাড়ায় ব্যারিস্টার সুমনের ঘরের দিকে। সরাসরি উঠোন পেরোলে কারো নজরে পড়ে যেতে পারে তাই সে বাড়ির পাশের পথ ধরে এগোয় আর নজর রাখে বাড়িটির দিকে যেনো কেউ আসা যাওয়া করলে করিম দেখতে পারে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই সে ব্যারিস্টার সুমনের ঘরটির সামনে এসে উপস্থিত হয়। পাকা দালানের কাঁচের জানালা দিয়ে সে ভেতরে তাকায়। প্রথমে সে চোখকে বিশ্বাস করতে চায়নি। একটা ছোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে জহরুদ্দীনের বৌ। তার কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারিস্টার সুমন। করিমের বুঝতে বাকি থাকে না কি হতে যাচ্ছে। তার রক্তের ভেতর একটি ব্যাঘ্র যেনো জেগে উঠে নিমেষে। সে অন্ধকারে ঝাঁপটি মেরে অপেক্ষা করে কখন দরোজা খুলে বেরিয়ে আসবে দু’জন।

পরদিন সকালে জহরুদ্দীনের বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। ব্যারিস্টার সুমনের ঘরের সামনে থেকে পাওয়া গেছে জহরুদ্দীনের বৌ ও ব্যারিস্টার সুমনের লাশ। আর তার পাশে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গেছে করিমকে। তার সারা দেহে বেশ কিছু গভীর ক্ষত। মুখের কাছে বেশ অনেকটা জায়গা থেতলে আছে। গ্রামবাসী ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু করিমের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ব্যারিস্টারের ঘরের দুয়ারে জহরুদ্দীনের বৌয়ের লাশ পেয়ে লোকে নানা কথা বলাবলি করছে। জহরুদ্দীন যেনো দুঃখে অপমানে একেবারে মরমে মরে গেছে। একটা গাছের নিচে থ মেরে বসে আছে সে। অজগ্রাম, এখনও পুলিশ আসেনি। একজন চৌকিদার আর করিমের বৌ করিমের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। সবার ধারণা করিমই এ খুন দুটো করেছে। কিন্তু করিম কেনো খুন করলো এদেরকে। ব্যারিস্টারই তো তাকে জেল থেকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছে। তাহলে সে ব্যারিস্টারকে খুন করতে যাবে কেনো। কেউ কেউ বলছে, করিমের মাথাটা একেবারেই গেছে। ভয়ানক খুনে হয়ে উঠেছে করিম। ফিরিৎ ফিরিৎ করে বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়। পুলিশ এসেছে। পুলিশের লোকজন লাশদুটোকে পরীক্ষা করে। তাদের সাথে থাকা সরকারী ডাক্তার কিছুক্ষণ চেষ্টার পর করিমের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। তার ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজে বাঁধা হয়। করিম নেশাগ্রস্থের মতো উঠে বসে। সবার উৎসুক চোখ এখন করিমের দিকে। সে কি বলে সবাই শুনতে অধীর হয়ে আছে। পুলিশের একজন বুড়ো মতো লোক করিমকে প্রশ্ন করে।
--তোমার নাম?
--করিম মিয়া
--এখানে কখন এলে?
--রাতে।
--খুন দুটো তুমি করেছো?
করিম চোখ তুলে দেখে অদূরে জহরুদ্দীন তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে করিমের স্ত্রী আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। করিমের একবার ইচ্ছে করে, মিথ্যে কথা বলতে। একবার ইচ্ছে করে বলতে যে, সে এসবের কিছুই জানে না। সে আবার চোখ ঘুরিয়ে জহরুদ্দীনের দিকে তাকায়। সে দেখে জহরুদ্দীনের চোখ দু’টি আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে করিম। বুড়ো পুলিশ হাতের লাঠিটি ঘুড়িয়ে ধমকে উঠে। করিম অস্ফুট স্বরে বলে,
--হ, আমি খুন করছি।
কথাটি শোনামাত্র আগুনের শিখার মতো জ্বলে উঠে জহরুদ্দীন। তার বৌয়ের লাশ যে ছোট ভাইয়ের ঘরের দরোজায় পাওয়া গেছে; সে সামাজিক অসম্মানের কথা সে ভুলে যায় নিমিষেই। ক্রোধে দাঁতে দাঁত কষে এগিয়ে আসে করিমের দিকে। “নিমকহারাম, বেইমান” বলে সে করিমের গালে শরিরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কষে চর মারে। জহুরুদ্দীনের লাঙলচষা আঙ্গুল করিমের গালে নরকের কাটার মতো বিধে যেতে থাকে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান